২০২৫ সালের ৮ এপ্রিল বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিয়েছে। ঢাকায় একটি আনুষ্ঠানিক স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশ নাসার নেতৃত্বাধীন আর্টেমিস অ্যাকর্ডে ৫৪তম দেশ হিসেবে যোগ দিয়েছে। এই অ্যাকর্ডটি মহাকাশে নিরাপদ, টেকসই এবং শান্তিপূর্ণ অনুসন্ধানের জন্য একটি নির্দেশিকা, যা মানবজাতির স্বার্থে মহাকাশ গবেষণাকে এগিয়ে নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশের এই যোগদান দেশটির জন্য মহাকাশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে।
আর্টেমিস অ্যাকর্ড কী?
২০২০ সালে নাসা এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের নেতৃত্বে সাতটি প্রতিষ্ঠাতা দেশের সঙ্গে আর্টেমিস অ্যাকর্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি এমন একটি নীতিমালা, যা মহাকাশে স্বচ্ছ, নিরাপদ এবং শান্তিপূর্ণ কার্যক্রম নিশ্চিত করতে দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করে। এই অ্যাকর্ড ১৯৬৭ সালের আউটার স্পেস ট্রিটি, রেজিস্ট্রেশন কনভেনশন এবং রেসকিউ অ্যান্ড রিটার্ন এগ্রিমেন্টের মতো আন্তর্জাতিক চুক্তির ওপর ভিত্তি করে গঠিত। এটি বিজ্ঞানসম্মত ডেটার প্রকাশ্য বিনিময়, মহাকাশে ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণ এবং মঙ্গল ও চাঁদে সম্পদ ব্যবহারের নীতি প্রচার করে। বর্তমানে ৫৪টি দেশ এই অ্যাকর্ডে স্বাক্ষর করেছে, যার মধ্যে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় দেশ, ভারতের পরে।
স্বাক্ষর অনুষ্ঠান
ঢাকায় ২০২৫ সালের বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিটের সময় এই স্বাক্ষর অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আশরাফ উদ্দিন সরকারের পক্ষে এই অ্যাকর্ডে স্বাক্ষর করেন। অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন উপস্থিত ছিলেন। নাসার ভারপ্রাপ্ত প্রশাসক জ্যানেট পেট্রো একটি প্রাক-রেকর্ড করা ভিডিও বার্তায় বাংলাদেশের এই পদক্ষেপের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের অ্যাকর্ডে স্বাক্ষর মহাকাশ গবেষণার ভবিষ্যৎ গঠনে তাদের ভূমিকা নিশ্চিত করেছে। এটি আমাদের চাঁদ এবং তার বাইরের যাত্রাকে শান্তিপূর্ণ, টেকসই এবং স্বচ্ছ করার প্রতিশ্রুতি।”
বাংলাদেশের জন্য তাৎপর্য
বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “আর্টেমিস অ্যাকর্ডে বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি নাসা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে দেশের সম্পৃক্ততা বাড়াবে। এটি মহাকাশের উন্মুক্ত, দায়িত্বশীল এবং শান্তিপূর্ণ অনুসন্ধানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি তৈরি করবে।”
এই অ্যাকর্ডে যোগদান বাংলাদেশের জন্য একাধিক সুবিধা নিয়ে আসবে:
- প্রযুক্তি হস্তান্তর: নাসা এবং অন্যান্য মহাকাশ সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ উন্নত মহাকাশ প্রযুক্তি, স্যাটেলাইট সিস্টেম এবং বৈজযান্ত্রিক গবেষণার সুযোগ পাবে। এটি বাংলাদেশের স্পেস রিসার্চ অ্যান্ড রিমোট সেন্সিং অর্গানাইজেশন (স্পারসো)-এর কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করবে।
- বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা: বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষকরা নাসার প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, বৃত্তি এবং বিনিময় উদ্যোগে অংশ নিতে পারবেন। এটি তরুণ বিজ্ঞানীদের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করবে।
- অর্থনৈতিক সহযোগিতা: মহাকাশ প্রযুক্তির উন্নয়ন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে, বিশেষ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় স্যাটেলাইট প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে।
- জলবায়ু পর্যবেক্ষণ: স্পারসোর মাধ্যমে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে পৃথিবী পর্যবেক্ষণ এবং জলবায়ু-সম্পর্কিত গবেষণায় কাজ করছে। আর্টেমিস অ্যাকর্ড এই কার্যক্রমকে আরও উন্নত করবে, যা বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সহায়ক হবে।
বাংলাদেশের মহাকাশ গবেষণার ইতিহাস
বাংলাদেশ ১৯৮০ সালে স্পারসো প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মহাকাশ গবেষণায় পদক্ষেপ নিয়েছিল। এই সংস্থা দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক মান মেনে মহাকাশ বিজ্ঞানে কাজ করে আসছে। এছাড়া, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) গত ১১ বছর ধরে নাসার স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জ আয়োজন করে তরুণদের মধ্যে উদ্ভাবন ও বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ জাগিয়েছে। গত ছয় বছরের মধ্যে চারবার বাংলাদেশের দল এই প্রতিযোগিতায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, যা দেশের তরুণদের সম্ভাবনার প্রমাণ বহন করে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
আর্টেমিস অ্যাকর্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশ নাসার আর্টেমিস মিশনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে, যার লক্ষ্য চাঁদে মানুষের বসতি স্থাপন, মঙ্গল গ্রহের অনুসন্ধান এবং দীর্ঘমেয়াদী মহাকাশ গবেষণা। আর্টেমিস-১ ইতিমধ্যে চাঁদের কক্ষপথে অভিযান সম্পন্ন করেছে, এবং আর্টেমিস-২ ও ৩ যথাক্রমে মানুষের চাঁদে অবতরণ ও চন্দ্র স্পেস স্টেশন স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। বাংলাদেশ এই মিশনগুলোর সঙ্গে প্রযুক্তিগত এবং বৈজ্ঞানিক সহযোগিতার মাধ্যমে অবদান রাখতে পারবে।
এছাড়া, এই অ্যাকর্ড বাংলাদেশের তরুণদের জন্য নাসার প্রশিক্ষণ এবং গবেষণার সুযোগ তৈরি করবে। বেসিসের চেয়ারম্যান রাফেল কবির বলেন, “এই ধরনের উদ্যোগ আমাদের তরুণদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সৃজনশীলভাবে চিন্তা করার সুযোগ দেয়।”
আর্টেমিস অ্যাকর্ডে বাংলাদেশের যোগদান মহাকাশ গবেষণায় দেশের প্রতিশ্রুতি এবং সম্ভাবনার একটি উজ্জ্বল প্রমাণ। এটি কেবল প্রযুক্তিগত উন্নয়নই নয়, বৈশ্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশের তরুণদের মহাকাশ বিজ্ঞানে অবদান রাখার সুযোগ তৈরি করবে। নাসার সঙ্গে এই অংশীদারিত্ব বাংলাদেশকে মহাকাশের নতুন যুগে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে যাবে, যেখানে শান্তিপূর্ণ ও টেকসই অনুসন্ধানের মাধ্যমে মানবজাতির জন্য নতুন সম্ভাবনা উন্মোচিত হবে।
উৎস: এখানে ক্লিক করুন