সৌরজগতের বাইরে পৃথিবীর মতো গ্রহের সন্ধান মানবজাতির একটি প্রাচীন স্বপ্ন। এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এখন জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের হাতে শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি, সুইজারল্যান্ডের বার্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ন্যাশনাল সেন্টার অব কম্পিটেন্স ইন রিসার্চ প্ল্যানেটএস (এনসিসিআর প্ল্যানেটএস)-এর গবেষকরা একটি এআই-চালিত মডেল ব্যবহার করে ৪৪টি সম্ভাব্য পৃথিবীসদৃশ গ্রহের সন্ধান পেয়েছেন, যা আমাদের ছায়াপথে জীবনের সম্ভাবনা খুঁজে পাওয়ার পথে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
এআই কীভাবে এই গ্রহগুলো খুঁজে পেল?
এই আবিষ্কারের পেছনে রয়েছে বার্ন মডেল অব প্ল্যানেট ফরমেশন অ্যান্ড ইভোলিউশন, একটি অত্যাধুনিক সিমুলেশন যা কৃত্রিম তারকা সিস্টেম তৈরি করে এবং গ্রহ গঠনের জটিল প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করে। এই মডেলের ওপর ভিত্তি করে তৈরি এআই অ্যালগরিদমটি সূর্যের মতো জি-টাইপ তারা এবং ছোট, ঠান্ডা কে-টাইপ ও এম-টাইপ তারার চারপাশে প্রায় ১,৬০০টি গ্রহ ব্যবস্থা বিশ্লেষণ করেছে। এই এআই মডেলটি এমন গ্রহ চিহ্নিত করতে প্রশিক্ষিত, যেগুলো পৃথিবীর মতো আকারের এবং তাদের তারার বাসযোগ্য অঞ্চলে (হ্যাবিটেবল জোন) অবস্থিত, যেখানে তরল পানির অস্তিত্ব সম্ভব।
ড. ইয়ান অ্যালিবার্ট, গবেষণা দলের একজন সদস্য, বলেন, “এই মডেলটি বিশ্বের অন্যতম জটিল ও গভীর সিমুলেশন। এটি আমাদের এমন অধ্যয়ন করতে সক্ষম করেছে, যা আগে অসম্ভব ছিল।” এআই-এর এই সাফল্য প্রমাণ করে যে, এটি এমন গ্রহ শনাক্ত করতে পারে, যা ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে এতদিন অগোচরে ছিল।
পৃথিবীসদৃশ গ্রহ বলতে কী বোঝায়?
পৃথিবীসদৃশ গ্রহ বা ‘আর্থ-লাইক এক্সোপ্ল্যানেট’ বলতে এমন গ্রহকে বোঝায়, যেগুলো পৃথিবীর মতো শিলাময় (টেরেস্ট্রিয়াল), আকারে পৃথিবীর কাছাকাছি, এবং তাদের তারার বাসযোগ্য অঞ্চলে অবস্থিত, যেখানে তরল পানি থাকতে পারে। এই গ্রহগুলো জীবনের সম্ভাবনার দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ পানি জীবনের একটি মৌলিক উপাদান। এই ৪৪টি গ্রহের মধ্যে এমন বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা তাদের জীবন বহনের সম্ভাবনাময় করে তুলেছে।
জ্যোতির্বিজ্ঞানে এআই-এর ভূমিকা
এআই জ্যোতির্বিজ্ঞানে বিপ্লব ঘটাচ্ছে। এর আগেও এআই ব্যবহার করে নতুন গ্রহ আবিষ্কারের নজির রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালে জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এআই-এর মাধ্যমে একটি নতুন গ্রহ শনাক্ত করেছিলেন, যা প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্কের ডেটা বিশ্লেষণ করে পাওয়া গিয়েছিল। এছাড়া, নাসার কেপলার স্পেস টেলিস্কোপের ডেটা বিশ্লেষণে এআই ব্যবহার করে কেপলার-৯০ সিস্টেমে অষ্টম গ্রহটি আবিষ্কৃত হয়েছিল।
বর্তমান আবিষ্কারে এআই-এর ভূমিকা আরও উল্লেখযোগ্য, কারণ এটি এমন গ্রহ শনাক্ত করেছে, যেগুলো পূর্বে পর্যবেক্ষিত ডেটাতেও অগোচর ছিল। এআই মানুষের তুলনায় দ্রুত এবং নির্ভুলভাবে বিশাল ডেটা বিশ্লেষণ করতে পারে, যা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সময় ও শ্রম সাশ্রয় করছে।
এই আবিষ্কারের তাৎপর্য
এই ৪৪টি গ্রহের আবিষ্কার জীবনের সন্ধানে একটি বড় পদক্ষেপ। বর্তমানে ৫,৮০০টির বেশি এক্সোপ্ল্যানেট শনাক্ত করা হলেও, পৃথিবীসদৃশ গ্রহের সংখ্যা খুবই কম। এই নতুন গ্রহগুলোর মধ্যে কিছু গ্রহ এমন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, যা তাদের বাসযোগ্য করে তুলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, এই গ্রহগুলোর কোনোটিতে তরল পানি বা জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় বায়ুমণ্ডল থাকতে পারে।
এই আবিষ্কার ভবিষ্যৎ মিশনের জন্যও পথ দেখাবে। নাসার হ্যাবিটেবল ওয়ার্ল্ডস অবজারভেটরি এবং লার্জ ইন্টারফেরোমিটার ফর এক্সোপ্ল্যানেটস (লাইফ) এর মতো প্রকল্পগুলো এই গ্রহগুলোর বায়ুমণ্ডল পর্যবেক্ষণ করে জীবনের চিহ্ন (বায়োসিগনেচার) খুঁজবে।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ
এই গ্রহগুলো শনাক্ত হলেও, তাদের বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করতে আরও গবেষণা প্রয়োজন। গ্রহগুলোর বায়ুমণ্ডল, তাপমাত্রা, এবং ভূতাত্ত্বিক গঠন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের মতো উন্নত যন্ত্রপাতি এই কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
এছাড়া, এই গ্রহগুলোর দূরত্ব (কয়েক থেকে হাজার আলোকবর্ষ) তাদের পর্যবেক্ষণকে চ্যালেঞ্জিং করে তোলে। তবু, এআই-এর এই সাফল্য প্রমাণ করে যে, প্রযুক্তি আমাদের মহাবিশ্ব সম্পর্কে জানার সীমানা প্রসারিত করছে।
এআই-এর মাধ্যমে ৪৪টি পৃথিবীসদৃশ গ্রহের আবিষ্কার মহাবিশ্বে জীবনের সম্ভাবনা নিয়ে নতুন আশা জাগিয়েছে। এই গ্রহগুলো কেবল জ্যোতির্বিজ্ঞানের জন্যই নয়, মানবজাতির অস্তিত্বের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা কি মহাবিশ্বে একা? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো এই গ্রহগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে। এআই এবং উন্নত প্রযুক্তির সমন্বয়ে আমরা সেই উত্তরের আরও কাছে পৌঁছাচ্ছি।