স্টারলিংক, স্পেসএক্সের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান, বিশ্বব্যাপী উচ্চগতির স্যাটেলাইট-ভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা প্রদানের জন্য পরিচিত। বাংলাদেশে এই সেবা চালুর বিষয়টি গত কয়েক বছর ধরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে, স্টারলিংকের পরীক্ষামূলক সেবা শুরু এবং বাণিজ্যিক চালুর সম্ভাবনা নিয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ্য করা গেছে। এই আর্টিকেলে বাংলাদেশে স্টারলিংক সেবার বর্তমান অবস্থা, এর সম্ভাব্য প্রভাব এবং চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে।
বর্তমান অবস্থা
২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে স্টারলিংক ইন্টারনেট সেবা পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছে। ৯ এপ্রিল, ২০২৫, রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিটে বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল) স্টারলিংকের ইন্টারনেট সেবা প্রদর্শন করে। এই সামিটে দর্শনার্থীরা বিশেষ কিউআর কোড ব্যবহার করে বিনামূল্যে স্টারলিংকের উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পান। পরীক্ষায় ডাউনলোড গতি ১৭০ থেকে ২২০ মেগাবিট পার সেকেন্ড (এমবিপিএস) পর্যন্ত পাওয়া গেছে, যা বাংলাদেশের প্রচলিত ইন্টারনেট সেবার তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে দ্রুত।
২৯ মার্চ, ২০২৫, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) স্টারলিংককে বিনিয়োগ নিবন্ধনের অনুমোদন দেয়, এবং ২৮ এপ্রিল, ২০২৫, প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস স্টারলিংকের লাইসেন্স অনুমোদন করেন। এই অনুমোদনের ফলে স্টারলিংককে ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে কার্যক্রম শুরু করার সময় দেওয়া হয়েছে। তবে, বাণিজ্যিকভাবে সেবা চালুর জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) থেকে নন-জিওস্টেশনারি অরবিট (এনজিএসও) লাইসেন্স নিতে হবে। বিটিআরসিতে এই লাইসেন্সের জন্য স্টারলিংক ইতোমধ্যে আবেদন করেছে।
স্টারলিংকের সম্ভাব্য প্রভাব
স্টারলিংক বাংলাদেশে পুরোপুরি চালু হলে এটি বিভিন্ন খাতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সেবা দুর্গম এলাকায় উচ্চগতির ইন্টারনেট সরবরাহ করবে, যেখানে প্রচলিত ফাইবার অপটিক বা মোবাইল নেটওয়ার্ক পৌঁছাতে পারে না। এটি গ্রাম ও শহরের মধ্যে ডিজিটাল বৈষম্য কমাতে সহায়ক হবে।
- শিক্ষা ও ই-লার্নিং: স্টারলিংক প্রান্তিক অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্চগতির ইন্টারনেট সরবরাহ করবে, যা ই-লার্নিং, ভার্চুয়াল ক্লাসরুম এবং গবেষণার সুযোগ প্রসারিত করবে।
- অর্থনীতি ও ফ্রিল্যান্সিং: দ্রুতগতির ইন্টারনেট গ্রামীণ তরুণদের ফ্রিল্যান্সিং এবং ই-কমার্সে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করবে, যা বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়াতে সহায়ক হবে।
- দুর্যোগকালীন যোগাযোগ: প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সাবমেরিন কেবলনির্ভর ইন্টারনেট ব্যবস্থা ব্যাহত হলেও স্টারলিংক নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ নিশ্চিত করতে পারে।
- প্রতিযোগিতা: স্টারলিংকের আগমন বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়াবে, যা ইন্টারনেট সেবার মান উন্নত করতে এবং দাম কমাতে ভূমিকা রাখতে পারে।
খরচ ও প্যাকেজ
স্টারলিংকের ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য একটি কিট কিনতে হয়, যার মধ্যে রয়েছে স্যাটেলাইট ডিশ, রাউটার, কিকস্ট্যান্ড এবং পাওয়ার সাপ্লাই। এই কিটের দাম বিশ্ববাজারে ৩৪৯ থেকে ৫৯৯ মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৪১,০০০ থেকে ৭০,০০০ টাকা)। মাসিক সাবস্ক্রিপশন ফি রেসিডেনশিয়াল প্যাকেজের জন্য ৮০ থেকে ১২০ ডলার (প্রায় ৯,৪০০ থেকে ১৪,১০০ টাকা), তবে কর্পোরেট প্যাকেজের খরচ এর দ্বিগুণ হতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভুটানে স্টারলিংকের মাসিক ফি প্রায় ৫,৮০০ টাকা, যা বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাব্য রেফারেন্স হতে পারে। স্থানীয় বাজার এবং সরকারের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে দাম কিছুটা কমানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
চ্যালেঞ্জ
স্টারলিংকের উচ্চ খরচ সাধারণ গ্রাহকদের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা সীমিত করতে পারে। বাংলাদেশে স্থানীয় ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারীরা (আইএসপি) ৫০০ থেকে ১,০০০ টাকায় ৫-৩০ এমবিপিএস গতির সংযোগ দিচ্ছে, যা স্টারলিংকের তুলনায় অনেক সাশ্রয়ী। তাই, স্টারলিংক সম্ভবত প্রাথমিকভাবে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক ব্যবহারকারী এবং দুর্গম এলাকার গ্রাহকদের লক্ষ্য করবে।
এছাড়া, বিটিআরসির নীতিমালা অনুযায়ী, স্টারলিংককে স্থানীয় ব্রডব্যান্ড গেটওয়ে বা ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) ব্যবহার করতে হবে, যা অবকাঠামোগত বিনিয়োগের প্রয়োজন হতে পারে। সরকারের নজরদারি ও আড়িপাতার বিষয়টিও স্টারলিংকের কার্যক্রমে প্রভাব ফেলতে পারে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বাংলাদেশ সরকার এবং স্টারলিংকের মধ্যে চলমান আলোচনা এবং লাইসেন্স প্রক্রিয়া সফল হলে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে স্টারলিংক বাণিজ্যিকভাবে সেবা শুরু করতে পারে। প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এবং স্পেসএক্সের সিইও ইলন মাস্কের মধ্যে ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫-এ ফোনালাপে স্টারলিংক চালুর বিষয়ে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। এছাড়া, সরকার বিনিয়োগবান্ধব নীতি এবং সহজ লাইসেন্স প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্টারলিংকের প্রবেশকে ত্বরান্বিত করছে।