বাংলাদেশে অটোমোবাইল শিল্পের ভবিষ্যৎ: আগমনশীল গাড়ি ও প্রকল্প
বাংলাদেশের অটোমোবাইল শিল্প দক্ষিণ এশিয়ার একটি উদীয়মান খাত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং আধুনিকায়নের ফলে গাড়ির চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে উৎপাদন কারখানা স্থাপন, নতুন মডেলের গাড়ি প্রবর্তন এবং বৈদ্যুতিক যানবাহন (ইভি) প্রযুক্তির প্রসারে বিনিয়োগ করছে। এই আর্টিকেলে বাংলাদেশে অটোমোবাইল শিল্পের আগামী প্রকল্প, আগমনশীল গাড়ি এবং এই খাতের সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
বাংলাদেশের অটোমোবাইল শিল্পের বর্তমান চিত্র
বাংলাদেশের অটোমোবাইল শিল্প এখনো উন্নয়নশীল পর্যায়ে রয়েছে। বর্তমানে দেশে মোটরসাইকেল, অটোরিকশা, তিন চাকার যান (মিশুক) এবং কিছু যাত্রীবাহী ও বাণিজ্যিক গাড়ির উৎপাদন ও সংযোজন হয়। প্রাগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (পিআইএল) দেশের প্রাচীনতম ও বৃহত্তম গাড়ি সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠান, যারা মিত্সুবিশি পাজেরো স্পোর্টসহ বিভিন্ন গাড়ি সংযোজন করে। এছাড়া, মিত্সুবিশি, টয়োটা, হিনো এবং টাটার মতো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের গাড়ি স্থানীয়ভাবে সংযোজন করা হয়। মোটরসাইকেল উৎপাদনে ওয়ালটন, রানার অটোমোবাইলস, রোডমাস্টার এবং যমুনা অটোমোবাইলের মতো দেশীয় কোম্পানিগুলো উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।
২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ, যার মধ্যে ৪.১ লাখ যাত্রীবাহী গাড়ি এবং ৪৩.৪ লাখ মোটরসাইকেল রয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ব্যাংক লোনের সহজলভ্যতার কারণে গাড়ির বাজার দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে।
আগামী প্রকল্প ও বিনিয়োগ
বাংলাদেশের অটোমোবাইল শিল্পে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য প্রকল্প ঘোষণা করা হয়েছে, যা এই খাতের ভবিষ্যৎ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। নিচে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রকল্পের বিবরণ দেওয়া হলো:
1 মিত্সুবিশি মোটরসের বিনিয়োগ: ২০১৯ সালে জাপানের মিত্সুবিশি মোটরস চট্টগ্রামের মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়। এই প্রকল্পের লক্ষ্য প্রাথমিকভাবে গাড়ি সংযোজন এবং পরবর্তীতে পূর্ণাঙ্গ উৎপাদন কারখানা স্থাপন। মিত্সুবিশি পাজেরো স্পোর্টসহ তাদের জনপ্রিয় মডেলগুলো স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হবে, যা বাংলাদেশের বাজারে দাম কমাতে সহায়তা করবে।
2 ফটন মোটর ও এসিআই মোটরসের যৌথ উদ্যোগ: ২০১৮ সালে চীনা গাড়ি প্রস্তুতকারক ফটন মোটর এসিআই মোটরসের সাথে যৌথভাবে বাণিজ্যিক যানবাহন উৎপাদনের জন্য কারখানা স্থাপনের ঘোষণা দেয়। এই প্রকল্পটি বাণিজ্যিক যানবাহন যেমন ট্রাক এবং বাসের স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করছে।
3 বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড: চট্টগ্রামের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরে বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড বৈদ্যুতিক যানবাহন (ইভি) উৎপাদন ইউনিট স্থাপন করেছে। তারা ২০২৩ সালের মধ্যে স্থানীয়ভাবে তৈরি ইভি বাজারে ছাড়ার পরিকল্পনা করেছে। এই প্রকল্পের আওতায় টু-হুইলার, থ্রি-হুইলার, সেডান, হ্যাচব্যাক, স্পোর্টস গাড়ি, পিক-আপ এবং মিনি-ট্রাক উৎপাদন করা হবে।
4 সবার-ই ব্র্যান্ডের ইলেকট্রিক গাড়ি: দেশীয় উদ্যোগে ‘সবার-ই’ নামে একটি ইলেকট্রিক গাড়ি ব্র্যান্ড চালু করার পরিকল্পনা চলছে। এই গাড়িগুলো মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে এবং রপ্তানির জন্যও উপযোগী হবে। এই প্রকল্পটি বাংলাদেশের অটোমোবাইল শিল্পে একটি নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।
5 ওয়ালটনের বৈদ্যুতিক যানবাহন উদ্যোগ: দেশীয় ইলেকট্রনিক্স জায়ান্ট ওয়ালটন মোটরসাইকেল উৎপাদনে সফলতার পর বৈদ্যুতিক গাড়ি ও বাস উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে। তারা ইতোমধ্যে বৈদ্যুতিক মোটরসাইকেল এবং থ্রি-হুইলার বাজারে ছেড়েছে এবং ভবিষ্যতে বৈদ্যুতিক যাত্রীবাহী গাড়ির উৎপাদন শুরু করতে পারে।
আগমনশীল গাড়ি
বাংলাদেশের বাজারে বিভিন্ন ধরনের নতুন গাড়ি প্রবেশ করছে, বিশেষ করে বৈদ্যুতিক যানবাহনের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। নিচে আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশে আসার সম্ভাবনা রয়েছে এমন কিছু গাড়ির বিবরণ দেওয়া হলো:
1 বিওয়াইডি সিল (BYD Seal): চীনের শীর্ষস্থানীয় বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা বিওয়াইডি ২০২৪ সালের মার্চে বাংলাদেশে তাদের সিল মডেল চালু করেছে। এই গাড়ির দুটি মডেল—এক্সটেন্ডেড রেঞ্জ (৮৯.৯ লাখ টাকা) এবং পারফরম্যান্স মডেল (৯৯.৯ লাখ টাকা)—বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। এটি বাংলাদেশে বৈদ্যুতিক গাড়ির জনপ্রিয়তা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
2 টাটা নেক্সন ইভি (Tata Nexon EV): ভারতের টাটা মোটরস ২০২৩ সালের ঢাকা মোটর শোতে তাদের বৈদ্যুতিক গাড়ি নেক্সন ইভি প্রদর্শন করেছে। এই গাড়িটি মধ্যবিত্ত ক্রেতাদের জন্য সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব বিকল্প হিসেবে বাজারে আসতে পারে। টাটার পরিকল্পনা অনুযায়ী, বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে এই গাড়ির সংযোজন শুরু হতে পারে।
3 মিত্সুবিশি আউটল্যান্ডার পিএইচইভি (Outlander PHEV): মিত্সুবিশি তাদের প্লাগ-ইন হাইব্রিড গাড়ি আউটল্যান্ডার পিএইচইভি বাংলাদেশে আনার পরিকল্পনা করছে। এই গাড়িটি জ্বালানি সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব বৈশিষ্ট্যের কারণে মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত ক্রেতাদের কাছে জনপ্রিয় হতে পারে।
4 সবার-ই ইলেকট্রিক সেডান: দেশীয় ব্র্যান্ড ‘সবার-ই’ বাংলাদেশের বাজারে সাশ্রয়ী মূল্যের বৈদ্যুতিক সেডান আনার পরিকল্পনা করছে। এই গাড়িটি মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য উপযোগী হবে এবং স্থানীয় উৎপাদনের কারণে দাম তুলনামূলক কম হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
5 হুন্ডাই ও কিয়ার ইভি মডেল: দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্ডাই এবং কিয়া বাংলাদেশে তাদের বৈদ্যুতিক গাড়ি যেমন হুন্ডাই কোনা ইভি এবং কিয়া নিরো ইভি আনার সম্ভাবনা রয়েছে। এই গাড়িগুলো উন্নত প্রযুক্তি এবং দীর্ঘ রেঞ্জের জন্য পরিচিত।
6 মোটরসাইকেল ও থ্রি-হুইলার: বৈদ্যুতিক মোটরসাইকেল এবং থ্রি-হুইলারের চাহিদা বাড়ছে। ওয়ালটন, রানার এবং রোডমাস্টার নতুন বৈদ্যুতিক মোটরসাইকেল মডেল যেমন ওয়ালটন ইভি সিরিজ এবং রানার ই-রাইডার চালু করছে। এছাড়া, বৈদ্যুতিক অটোরিকশা এবং মিশুকের উৎপাদনও বাড়ছে।
বৈদ্যুতিক যানবাহনের উত্থান
বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সাশ্রয় এবং পরিবেশ সংরক্ষণের প্রতি গুরুত্ব বৃদ্ধির সাথে বাংলাদেশেও বৈদ্যুতিক যানবাহনের চাহিদা বাড়ছে। বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এবং ওয়ালটনের মতো প্রতিষ্ঠান বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনে বিনিয়োগ করছে। ঢাকায় ইতোমধ্যে তিনটি ইভি চার্জিং স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে, এবং ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং কুমিল্লায় আরও ৪০টি চার্জিং স্টেশন স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
বৈদ্যুতিক গাড়ির সুবিধার মধ্যে রয়েছে:
- জ্বালানি সাশ্রয়: তেলের খরচ নেই, যা পরিবহন খাতে বছরে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করতে পারে।
- পরিবেশবান্ধব: কার্বন নির্গমন কম, যা দূষণ রোধে সহায়ক।
- কম রক্ষণাবেক্ষণ খরচ: ইঞ্জিনভিত্তিক গাড়ির তুলনায় কম যান্ত্রিক সমস্যা।
তবে, বৈদ্যুতিক গাড়ির জনপ্রিয়তা বাড়াতে কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে, যেমন:
- চার্জিং স্টেশনের অভাব।
- উচ্চ প্রাথমিক মূল্য।
- জটিল রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া।
অটোমোবাইল শিল্পের সম্ভাবনা
বাংলাদেশের অটোমোবাইল শিল্পের সম্ভাবনা অপার। ‘অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রি ডেভেলপমেন্ট পলিসি ২০২১’ অনুযায়ী, স্থানীয় উৎপাদন এবং উপাদান সংগ্রহের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এই নীতি স্থানীয় শিল্পকে উৎসাহিত করবে এবং আমদানি নির্ভরতা কমাবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি গত এক দশকে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং গাড়ির বাজার প্রতি বছর ৮% হারে বাড়ছে।
কিছু উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা হলো:
- মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতা: প্রায় ১.২ কোটি মানুষের গাড়ি কেনার সামর্থ্য রয়েছে।
- ব্যাংক লোনের সহজলভ্যতা: সুদের হার কমার ফলে গাড়ি কেনা সহজ হচ্ছে।
- রপ্তানি সম্ভাবনা: স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত গাড়ি এবং মোটরসাইকেল রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।
- পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি: বৈদ্যুতিক গাড়ির প্রসার টেকসই উন্নয়নের পথে নিয়ে যাবে।
চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
অটোমোবাইল শিল্পের সম্প্রসারণে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে:
- অবকাঠামোর অভাব: চার্জিং স্টেশন এবং উৎপাদন সুবিধার সীমাবদ্ধতা।
- উচ্চ কর: আমদানি কর এবং রেজিস্ট্রেশন ফি গাড়ির দাম বাড়ায়।
- দক্ষ কর্মী: উন্নত প্রযুক্তির জন্য দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন।
- অর্থনৈতিক চাপ: বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা বিনিয়োগে প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশের অটোমোবাইল শিল্প একটি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মিত্সুবিশি, ফটন, বিওয়াইডি এবং টাটার মতো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের পাশাপাশি ‘সবার-ই’ এবং ওয়ালটনের মতো দেশীয় উদ্যোগ এই খাতকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে। বৈদ্যুতিক যানবাহনের প্রসার, স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের গাড়ির বাজার আগামী দশকে বিশ্ববাজারে প্রভাব ফেলতে পারে। সঠিক নীতি ও বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ অটোমোবাইল শিল্পে একটি শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।