স্ট্রিং তত্ত্ব (String Theory) পদার্থবিজ্ঞানের একটি তাত্ত্বিক কাঠামো, যা মহাকর্ষ (Gravity) এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে একীভূত করার চেষ্টা করে। এটি একটি সম্ভাব্য “থিওরি অফ এভরিথিং” (Theory of Everything) হিসেবে বিবেচিত হয়, যা মৌলিক কণা এবং প্রকৃতির চারটি মৌলিক বল—মহাকর্ষ, তড়িৎচুম্বকত্ব, শক্তিশালী নিউক্লীয় বল, এবং দুর্বল নিউক্লীয় বল—কে একটি একক গাণিতিক মডেলে ব্যাখ্যা করতে পারে। তবে, আজকের দিন পর্যন্ত (৯ এপ্রিল, ২০২৫) স্ট্রিং তত্ত্বের সরাসরি পরীক্ষামূলক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এটি এখনও একটি তাত্ত্বিক ধারণা হিসেবে রয়ে গেছে, যার গাণিতিক সৌন্দর্য এবং সম্ভাবনা অনেক পদার্থবিজ্ঞানীকে আকৃষ্ট করলেও, এর বাস্তবতা প্রমাণের জন্য কোনো নির্দিষ্ট পরীক্ষা সফল হয়নি। নিচে স্ট্রিং তত্ত্বের প্রমাণের অবস্থা এবং এর বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
স্ট্রিং তত্ত্বের প্রমাণ মিলেছে কি?
স্ট্রিং তত্ত্বের সরাসরি প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। এর কয়েকটি কারণ রয়েছে:
-
অতিক্ষুদ্র স্কেল:
স্ট্রিং তত্ত্বের মূল ধারণা হলো, মৌলিক কণাগুলো বিন্দুর মতো (zero-dimensional) নয়, বরং এক-মাত্রিক “স্ট্রিং” বা সুতোর মতো। এই স্ট্রিংগুলো অত্যন্ত ক্ষুদ্র, প্রায় প্ল্যাঙ্ক স্কেলে (১০⁻³⁵ মিটার) অবস্থান করে। আমাদের বর্তমান প্রযুক্তি, যেমন লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার (LHC), এত ছোট স্কেলে পরীক্ষা করার ক্ষমতা রাখে না।
-
অতিরিক্ত মাত্রা (Extra Dimensions):
স্ট্রিং তত্ত্বে ১০ বা ১১টি মাত্রার (dimensions) প্রয়োজন হয়, যেখানে আমরা কেবল ৪টি মাত্রা (তিনটি স্থানিক এবং একটি সময়) উপলব্ধি করি। বাকি মাত্রাগুলো “কমপ্যাক্টিফাইড” বা অতিক্ষুদ্র আকারে গুটিয়ে থাকার কথা বলা হয়। এই অতিরিক্ত মাত্রার কোনো পরীক্ষামূলক প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি।
-
সুপারসিমেট্রি (Supersymmetry):
স্ট্রিং তত্ত্বের অনেক মডেল সুপারসিমেট্রির ওপর নির্ভর করে, যা বলে প্রতিটি কণার একটি “সুপারপার্টনার” কণা থাকা উচিত। কিন্তু LHC-এর মতো শক্তিশালী পরীক্ষাগারেও এই সুপারপার্টনার কণার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এটি স্ট্রিং তত্ত্বের কিছু সংস্করণের জন্য একটি বড় ধাক্কা।
-
পরীক্ষণযোগ্য ভবিষ্যদ্বাণীর অভাব:
স্ট্রিং তত্ত্ব এখনও এমন কোনো নির্দিষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেনি যা পরীক্ষার মাধ্যমে সরাসরি যাচাই করা যায়। এটি ১০⁵০০টিরও বেশি সম্ভাব্য “ভ্যাকুয়াম স্টেট” বা মহাবিশ্বের কনফিগারেশনের কথা বলে, যার মধ্যে আমাদের মহাবিশ্ব কোনটি তা নির্দিষ্ট করা কঠিন। এই বিশাল “ল্যান্ডস্কেপ” পরীক্ষার পথে বাধা সৃষ্টি করে।
তবে, স্ট্রিং তত্ত্ব সম্পূর্ণভাবে ভুল প্রমাণিত হয়েছে বলা যায় না। এটি গাণিতিকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং কিছু তাত্ত্বিক সমস্যার (যেমন, ব্ল্যাক হোল এনট্রপি এবং কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি) সমাধান দিয়েছে। AdS/CFT সংশ্লেষণ (Correspondence) এর মতো ধারণা ব্ল্যাক হোল তথ্য প্যারাডক্সের সমাধানে সাহায্য করেছে, যা স্ট্রিং তত্ত্বের পক্ষে একটি পরোক্ষ সমর্থন। কিন্তু এগুলো সরাসরি প্রমাণ নয়।
স্ট্রিং তত্ত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত
যদিও স্ট্রিং তত্ত্বের প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি, তবুও এর ধারণা এবং সম্ভাবনা বোঝার জন্য নিচে এটির বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হলো:
-
মূল ধারণা:
- স্ট্রিং তত্ত্বে বলা হয়, মৌলিক কণা (যেমন, ইলেকট্রন, কোয়ার্ক) আসলে বিন্দু নয়, বরং এক-মাত্রিক স্ট্রিং। এই স্ট্রিংগুলো বিভিন্নভাবে কম্পিত (vibrate) হয়, এবং তাদের কম্পনের ধরন অনুসারে বিভিন্ন কণার বৈশিষ্ট্য (যেমন ভর, চার্জ) নির্ধারিত হয়।
- এটি স্ট্যান্ডার্ড মডেলকে (Standard Model) প্রতিস্থাপন বা সম্প্রসারণ করতে চায়, যা কণা এবং বলের ব্যাখ্যা দেয় কিন্তু মহাকর্ষকে অন্তর্ভুক্ত করে না।
-
ইতিহাস:
- ১৯৬০-এর দশকে স্ট্রিং তত্ত্ব প্রথম প্রস্তাবিত হয় শক্তিশালী নিউক্লীয় বল ব্যাখ্যা করার জন্য। তবে, কোয়ান্টাম ক্রোমোডায়নামিক্স (QCD) এই কাজে সফল হওয়ায় এটি পরিত্যক্ত হয়।
- ১৯৭০-এর দশকে পদার্থবিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন যে, স্ট্রিং তত্ত্বে গ্র্যাভিটন (মহাকর্ষের কণা) স্বাভাবিকভাবে উৎপন্ন হয়, যা এটিকে কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির তত্ত্ব হিসেবে পুনরুজ্জীবিত করে।
- ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে “প্রথম এবং দ্বিতীয় স্ট্রিং বিপ্লব” এর মাধ্যমে এটি আরও উন্নত হয়, যখন M-থিওরি এবং D-ব্রেনের মতো ধারণা যোগ হয়।
-
গাণিতিক কাঠামো:
- স্ট্রিং তত্ত্বে ১০টি মাত্রার প্রয়োজন হয় (বা M-থিওরিতে ১১টি)। এই অতিরিক্ত মাত্রাগুলো ক্যালাবি-ইয়াউ ম্যানিফোল্ড নামে জটিল জ্যামিতিক আকারে গুটিয়ে থাকে।
- এটি সুপারসিমেট্রি ব্যবহার করে, যা বোসন (যেমন ফোটন) এবং ফার্মিয়ন (যেমন ইলেকট্রন)-এর মধ্যে সমতা ধরে।
- AdS/CFT সংশ্লেষণের মতো গাণিতিক মডেল এটিকে ব্ল্যাক হোল এবং কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরির সঙ্গে সংযুক্ত করেছে।
-
সম্ভাব্য প্রমাণের পথ:
- সুপারসিমেট্রি: যদি ভবিষ্যতে উচ্চ-শক্তির কণা সংঘর্ষে সুপারপার্টনার কণা পাওয়া যায়, তবে এটি স্ট্রিং তত্ত্বের পক্ষে পরোক্ষ প্রমাণ হতে পারে।
- মহাজাগতিক পর্যবেক্ষণ: প্রাথমিক মহাবিশ্বের ইনফ্লেশন (Inflation) বা কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ডে স্ট্রিং তত্ত্বের স্বাক্ষর (যেমন কসমিক স্ট্রিং) পাওয়া গেলে এটি সমর্থন পেতে পারে।
- গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ: ভবিষ্যৎ গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ ডিটেক্টর (যেমন LISA) অতিরিক্ত মাত্রার প্রভাব ধরতে পারে।
-
সুবিধা ও সমালোচনা:
-
সুবিধা: এটি গ্র্যাভিটি এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে একীভূত করার একমাত্র সামঞ্জস্যপূর্ণ তত্ত্ব হিসেবে বিবেচিত। এটি গণিতে (যেমন মিরর সিমেট্রি) এবং ব্ল্যাক হোল তত্ত্বে অবদান রেখেছে।
-
সমালোচনা: অনেকে বলেন, এটি পরীক্ষণযোগ্য নয়, তাই “বিজ্ঞান” নয়, বরং দর্শনের কাছাকাছি। এর বিশাল ল্যান্ডস্কেপও এটিকে অস্পষ্ট করে।
-
স্ট্রিং তত্ত্বের প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি, তবে এটি পদার্থবিজ্ঞানে একটি গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক কাঠামো হিসেবে রয়ে গেছে। এর গাণিতিক সৌন্দর্য এবং সম্ভাবনা অনেক পদার্থবিজ্ঞানীকে আকৃষ্ট করে, কিন্তু পরীক্ষামূলক প্রমাণের অভাবে এটি বিতর্কিত। ভবিষ্যতে উন্নত প্রযুক্তি এবং পর্যবেক্ষণ যদি এর ভবিষ্যদ্বাণী যাচাই করতে পারে, তবে এটি পদার্থবিজ্ঞানে বিপ্লব আনতে পারে। ততক্ষণ পর্যন্ত, এটি একটি “সুন্দর ধারণা” হিসেবে বিবেচিত হবে, যার সত্যতা প্রমাণের অপেক্ষায় রয়েছে।